বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২

হিন্দু স্টুয়ার্ট

 কলকাতা মহানগরী। ২০১১ -র এপ্রিল। ব্যাক্তিগত কাজে একাই আসা। হাতে ছিল কিছুটা অবসর সময়। তাই সচরাচর যা করা হয় না তাই করেছি। ফুটপাতে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেয়েছি। নৌকা করে বেলুড় থেকে গেছি দক্ষিণেশ্বর। রাস্তার ধারের সস্তা হোটেলে খেয়েছি মাছ-ভাত। বাসে ট্রামে করে কলকাতার পথে প্রান্তরে চষে বেরিয়েছি, গল্প-উপন্যাসে পড়া কলকাতা তিলোত্তমাকে খুব কাছে থেকে দেখবো বলে।

এরই এক ফাঁকে গিয়েছিলাম সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটরিতে। যেখানে রয়েছে ইংরেজ সাহেবদের কবর ও সমাধি সৌধ। সত্যজিৎ রায়ের লেখা, সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় গোরস্থানে সাবধান (২০১০) ছবিটির শূটিং হয়েছিল এখানেই। এই যায়গাটিতে শুয়ে আছেন তখনকার সময়ের অনেক বিখ্যাত মানুষ। ভাষাতত্ত্ববিদ ও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস, কবি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো, বিশ্ব বিখ্যাত ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের ছেলে ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্স, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা প্রদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি ইলাইজ়া ইম্পে, প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কলিন ম্যাকেঞ্জি সহ অনেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সম্ভবত এটিই ছিল ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম খ্রিস্টান সেমেটরি যা ১৭৬৭ থেকে ১৮৩০ অবধি সচল ছিল।
ভর-দুপুর বেলায় শ্যাওলা-ধরা কংক্রিট আর গা ছমছম করা নিস্তব্ধ পরিবেশে একা একা হাটতে হাটতে হঠাৎ এক সাহেবের সমাধি্র সামনে এসে দাঁড়াই। দেখতে পাই ভেতরে সমাধি-ফলকের ঠিক নিচে একটি পথ-কুকুর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। বুঝতে পারি যায়গাটা কত অবহেলিত। ফলক পড়ে জানতে পারি এটা জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্টের সমাধি, যিনি হিন্দু স্টুয়ার্ট নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এই সমাধিটি দেখতে বাকিগুলো থেকো একে বারেই আলাদা। অনেকটা হিন্দু মন্দিরের আদলে গড়া।
জানতে ইচ্ছে হলো কে এই হিন্দু স্টুয়ার্ট। আইরিশ এই সাহেবটি ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফার্স্ট বেঙ্গল ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার। ভারতে এসেছিলেন খুব অল্প বয়সে। আর এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৮২৮ সালের ৩১ মার্চ। মনে প্রাণে এই সাহেব ভারতীয় জীবন ধারা গ্রহণ করেছিলেন। এমন কি প্রেমেও পড়ে ছিলেন এক ভারতীয় নারীর। এই দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গ সাহেব গঙ্গাতে ধুতি-উত্তরীয় পরে নাকি নিয়মিত স্নান করতে যেতেন তাঁর কষ্টিপাথরের তৈরি, গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের বালগোপাল কে নিয়ে। ছিলেন কৃষ্ণ ভক্ত। বেদ-উপনিষদ্‌-পুরাণ-মহাকাব্য-সহ সব রকমের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধীয় শাস্ত্রপুঁথি ছিল তাঁর নখদর্পণে। তাঁর দেশীয় সাহেবসুবোরা তাঁকে ব্যঙ্গ করে ডাকতেন ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’ বলে। তিনি তাঁর স্বদেশীয় সাহেবদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভালোবেসে ফেলেছিলেন ধুতি-নেংটী পরা নেটিভদের।
এদেশের পোষাক-আষাক-রীতিনীতি সব কিছুকেই তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। ভারতীয় শাড়িতে মুগ্ধ স্টুয়ার্ট বলতেন শাড়ির মত ভাল আর কোন পোষাকই হয় না। ইউরোপের নারীদেরও শাড়ি পরার জন্য আহব্বান জানান। তাঁর মতে শাড়ি হলো 'elegant, simple, sensible, and sensual'।
কবরে শায়িত হিন্দু স্টুয়ার্ট কে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মন চলে গিয়েছিল সেই সময়কার কলকাতায়। ভাবছিলাম এই সাহেব কে নিয়েই হতে পারে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। হবে হয়তো এক দিন।

পু ন র্মি ল ন 🍂

  দেখা হলো মুঠোফোনে! 'জীবন গিয়েছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার'! না তার থেকেও বেশী হবে? ফিরে ফিরে আসে কাঠালতলা-কুসুম ভোর, মনপড়ে বয়েস হোষ্ট...