বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২

প র বা সে ন ব ব র্ষ

প্রবাসে দৈবের বশে এবার পনেরো বছর পূর্ণ হলো আমাদের। মনে পড়ে পনেরো বছর পূর্বে বাংলা নববর্ষের একদিন আগে দূরগামী উড়ুজাহাজে চড়ে পা-রেখেছিলাম ত্তশেনিয়ার এই দ্বীপ রাস্ট্র অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে। হঠাৎ করেই চাকরিটা পেয়ে চলে আসা। এটিই হলো আমাদের মানে আমি এবং আমার স্ত্রীর প্রথম বিদেশ যাত্রা। কখনো ভাবিনি এই শহরটাই একদিন হয়ে উঠবে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। বরাক উপত্যকার আলো-হাওয়া-রোদ্দুরে বেড়ে ওঠা এই সদ্য বিবাহিত বাঙালি দম্পতির কাছে তখন এদেশের সব কিছুই ছিল নতুন। যানজটহীন-ঝকঝকে-তকতকে-রাস্তাঘাট দেখে আমাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। কালক্রমে সেই প্রথম দেখার বিস্ময় আজ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

যদিও নতুন কোন দেশে মানিয়ে নিতে একটু বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হয়, আমাদের ক্ষেত্রে ব্যপারটা অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমরা হোটেলে না উঠে, উঠেছিলাম এক বন্ধুর বাড়িতে। যেদিন সিডনি পৌঁছলাম তার পরদিনই বন্ধুটি নিয়ে গেলো টেম্পি পার্কের বৈশাখী মেলায়। আয়োজক প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটি। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ লেকের জলের ধারে পার্কের বিশাল সবুজ মাঠে মেলা বসেছে। অস্থায়ী তাঁবুতে নানান রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রবাসী বাঙালিরা। সুদুর অস্ট্রেলিয়ায় এসে একসঙ্গে উৎসবমুখর এত বাঙালি দেখে আমরা যার পর নাই আনন্দিত হয়েছিলাম সেদিন। সেটাই দেশের বাইরে আমাদের প্রথম নববর্ষ উদ্‌যাপন।
আমরা বাঙালিরা যেখানেই যাই সেখানেই দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যাই। সেই ধারা বজায় রেখে, সিডনিতেও বৈশাখী মেলা হয় দু’টি। একটি টেম্পি পার্কে(স্থান পরিবর্তিত হয়ে এখন ফেয়ারফিল্ড সো গ্রাউন্ডে) আর অন্যটি অলিম্পিক পার্কে। এই অলিম্পিক পার্কের মেলাটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঙালি মেলা। প্রতি বছরই মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকি। এই উপলক্ষ্যে শুধু সিডনি-ক্যানবেরাই নয়, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি বহির্দেশ থেকেও বাঙালিরা আসেন সিডনিতে। প্রবাসে দুই বাঙলার মানুষ মিলে মিশে আনন্দে মেতে উঠেন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকে আসেন নামি দামি শিল্পীরা। লোকে টিকেট কেটে মেলা দেখে। বিভিন্ন পণ্যের স্টল বসে। নানা রকমের সুস্বাদু খাবার, বই, পোশাক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকে মেলা প্রাঙ্গণে।
কে না জানে যে বাঙালি বরাবরই এক স্মৃতিবিলাসী জাতি। এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসেও নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের স্মৃতি আমাদের কাছে ফিরে ফিরে আসে। পয়লা বৈশাখে নতুন কাপড় পরা, ভালো খাওয়া-দাওয়া কিংবা দোকানে দোকানে ঘুরে শুভ হালখাতার মিষ্টি মুখ করা - কিছুই ভুলি না। প্রবাসে এসেও স্বচ্ছল বাঙালির স্মৃতিবিলাসের কোন কমতি নেই। ইন্টারনেটে একটু সার্চ দিলেই দেখা যাবে নিউইয়র্ক, লন্ডন থেকে শুরু করে সূদুর টোকিওর নববর্ষ উদ্‌যাপনের ছবি। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণের উৎসব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা - এখন কার্নিভ্যাল রূপ ধারণ করেছে। ইন্টারনেট আর ফেইসবুকের বদৌলতে সে খবর সবারই এখন জানা।
বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অংশ পয়লা বৈশাখের মেলা ও উদ্‌যাপনের ছবিটা অনেক খানিই পাল্টেছে আজ। এক সময় যে জাতি ছিল কৃষিনির্ভর সে আজ বসতি গড়েছে নগরে। ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে। আগেকার দিনে মেলায় পাওয়া যেত মাটির বাসন, কাঠের তৈজসপত্র, তালপাতার বাঁশি। সেই চিত্র আজ আর চোখে পড়ে না। সময়ের সাথে মেলার চরিত্রও পাল্টেছে। কিন্তু মাত্র কয়েক প্রজন্ম পেছনে গেলেই আমরা আমাদের কৃষিনির্ভর পূর্বপুরুষের শরীরে পলিমাটির গন্ধ খুঁজে পাবো। সেটাই আমাদের কিংবদন্তি। আমাদের শরীর-মন আজও গোপনে বহন করে চলেছে আমাদের পূর্বপুরুষের সেই পরম্পরা। এটা বুঝতে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হয় না। এই দূরদেশের বৈশাখী মেলায় এসেও দেখতে পাই প্রবাসী বাঙালিরা পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ ভাজায় রসনা বিলাস করছে পরম তৃপ্তিতে। এ যেন সেই অতীতের গ্রাম্যজীবনে ফিরে যাওয়ার আকূল চেষ্টা।
বাঙলা নববর্ষ মোঘল সম্রাটদের হাত ধরে এসেছিল কৃষিবর্ষ বা খাজনাবর্ষ হিসেবে। হালখাতা, পুণ্যাহ অনুষ্ঠান সেই দিনগুলোরই ইঙ্গিত করে। কিন্তু কালক্রমে বাঙালি এই দিনটিকে সর্বজনীন উৎসবের দিনে পরিণত করেছে। যে দিনটি ছিল শোষনের প্রতীক, খাজনা আদায়ের দিন, সেই দিনকেই বাঙালি করে তুলেছে আনন্দের দিন। চৈত্র মাসের খরতাপ-অনাবৃষ্টির পরে এ যেন বৈশাখের বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি। সেই গ্রামীণ লোকায়ত জীবন থেকে বাংলা বর্ষবরণ আজ উঠে এসেছে শহুরে জটিল জীবনের আবহে। এই প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনে বাঙলা ক্যালেণ্ডারের কোন যায়গা নেই। এখানে পয়লা বৈশাখ আসে এপ্রিল মাসে। এপ্রিল ফুলের দিন থেকেই অনলাইনে শাড়ি, পাঞ্জাবীর কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। প্রবাসে পরবাসে থেকেও এই একটি দিন বঙ্গ-সন্তানেরা শাড়ি পাঞ্জাবী পড়ে বৈশাখী মেলায় যায়। মাটির পাত্রে পান্তা-ইলিশ খায়। পিকনিক পিকনিক অনুভূতি হয়। এই দেখে মনে পড়ে যায় ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’।

পু ন র্মি ল ন 🍂

  দেখা হলো মুঠোফোনে! 'জীবন গিয়েছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার'! না তার থেকেও বেশী হবে? ফিরে ফিরে আসে কাঠালতলা-কুসুম ভোর, মনপড়ে বয়েস হোষ্ট...