শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৩

ফেবু স্ট্যাটাস #২

এখানে ও বৃষ্টি হয়। আকাশ কাঁদে। শুধু শৈশবের সেই টিনের চালে, রিম-ঝিম বৃষ্টি পড়ার শব্দগুলো শুনতে পাইনা। পাইনা পরিচিত সেই ভেজা মাটির সোঁদাগন্ধ। বৃষ্টিভেজা লোডশেডিংয়ের রাতে আলো আধাঁরের খেলায় শুনা হয় না সুয়োরানী-দুয়োরানীর গল্প।

শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৩

ফেবু স্ট্যাটাস #১

আমারা যে কেন এক সাথে থাকতে পারলাম না। বলেছিল এক সহোদর । আমরা এক এক জন, আলাদা আলাদা দ্বীপ। নিজের মতো করে সম্পন্ন মানুষ । কেন যে সামগ্রিক ভাবে সম্পন্ন হতে পারলাম না। বলে ছিল আরও একজন । বড়াইলের নীলিমার হাতছানিতে, বড়ম বাবার মেলা থেকে যারা এক সাথে কিনেছিলাম তালপাতার বাঁশি, সেই আমরা , পাহাড়, জঙ্গল , নদী , সাগর পেরিয়ে, ছিটকে পরেছি এখানে ওখানে। এই বিজ্ঞাপণী সময়ে, ফ্ল্যাট বাড়ির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে, সম্পন্ন আমরা কী ভীষণ রকমের একা। উঁচু উঁচু দালান বাড়ির, ছোট ছোট ঘরে, প্রতি রাতে উঠে আসে আমাদের সম্মিলিত দিনের কোরাস । জিরি, চিরি, বরাক, সুরমার গ্রন্থনায় সে আমাদের নিজস্ব ভোর ।

শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৩

রাইনের মারিয়া রিলকের নবীন কবিকে লেখা চিঠি -২

ছায়া অনুবাদঃ দেবব্রত আচার্য

© ছবি

ভিয়ারগিয়ো, 
পিসার নিকটে ( ইতালি )
এপ্রিল ৫, ১৯০৩
  

   তোমার ২৪শে ফেব্রুয়ারি লিখা চিঠির উওর আজই দেয়া সম্ভব হচ্ছে । অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের জন্য ক্ষমা প্রার্থী । বেশ কিছুদিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপে কাবু হয়ে পড়েছি ।বলা যায় কার্যত আমাকে অচল করে দিয়েছে । শেষ পর্যন্ত দক্ষিণের সমুদ্র তটে হাওয়া বদলে এসে চেষ্টায় আছি শরীরটাকে একটু সুস্থ করার। আগেও এখানে একবার এসেছিলাম এমনি শরীর খারাপ নিয়ে। সেরেও উঠেছিলাম সে বার ।  এই অসুস্থতা হেতু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও  বড় করে চিঠি লিখা সম্ভব হবে না। লেখাটা এই মুহূর্তে বেশ কষ্টকর কাজ আমার জন্য।

      তোমার  চিঠি যেমনি আমাকে আমোদিত করে, তেমনি আমার উওর গুলো পড়তে পড়তে তুমিও নিশ্চয় হারিয়ে যাও । হয়ত বা তোমাকে কখন কখন সেগুলো নিরাশ করে। সত্যি বলতে কি জীবনের সবচেয়ে সুগভীর বিষয়গুলোতে আমরা সবাই ভীষণ রকমের একা। অনেক কিছু ঘটে যাওয়ার পর, অনেক পথ হেঁটে , সহস্র নক্ষত্র ঘটনার সাক্ষী হয়ে তবেই একজন মানুষ পারে অন্য এক মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে। সাহায্য করতে।

তোমাকে আজ  দুটি জিনিস বলতে চাই:

এক.  

       আয়রনী : একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে । তোমার সৃষ্টি সত্তা কে কখন এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দিও না। বিশেষ করে যখন ভালো কিছু লিখতে পারছো না; তখন আয়রনী আশ্রয় নিতে যেওনা । অন্যদিকে যখন তুমি পুরো মাত্রায় সৃজনশীল , তখনই এটিকে ব্যাবহার করতে পারো  অন্য এক বাচনভঙ্গি হিসেবে। যদি বিশুদ্ধতার সাথে একে ব্যবহার করা যায় তবে আয়রনীও বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। এতে লজ্জার কিছু নেই। যদি এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার তোমাকে চিন্তিত করে তুলে তবে অন্য কোন মহৎ কিংবা সিরিয়াস বিষয়ে মনোনিবেশ করো। যাতে নূতন এই বিষয়ের সামনে আয়রনী কে নিতান্তই ছোট আর অসহায় মনে হয়। বস্তুর গভীরে গিয়ে খোঁজো । তারপর ও যদি তোমার লেখায় আয়রনী থেকে যায় তা হলে ধরে নিতে হবে তোমার জীবন কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যসব মহৎ ও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কাজ করতে করতে হয়ত এটা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে ( যদি এটি  সাময়িক ভাবে এসে থাকে ) । আর যদি এটি তোমার ব্যক্তি স্বতন্ত্রতার  সাথে একীভূত হয়ে থাকে তবে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে । শিল্প-সৃষ্টির নূতন এক হাতিয়ার হিসেবে যুক্ত হবে তোমার ঝুলিতে। 


দুই.

      চারপাশের হাজারো বইয়ের ভীরে, কটা বই আছে যাদের ছাড়া আমার চলে না । তার মধ্যে দুটি বই আমার সাথে সব সময়ই থাকে। যেখানেই যাই না কেন, বই দুটি আমার সঙ্গে যায়। এর একটি হল বাইবেল আর  অন্যটি ডেনিশ কবি জেন্স পিটার জ্যাকবসনের লিখা। তুমি উনার  লেখা পড়েছ ? জ্যাকবসনের  লেখাগুলো খুব সহজেই তুমি সংগ্রহ করে নিতে পারবে ।  রিক্লেমস ইউনিভার্সাল লাইব্রেরি তার বেশ কটি বইয়ের সাবলীল অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে । তার 'ছয়টি ছোটগল্প' এবং ‘নিলস লিহনি’ নামক উপন্যাসটি সংগ্রহ করে নাও । গল্পগ্রন্থের  প্রথম গল্প ‘ম্যাগনেস’ থেকে পড়া শুরু কর। গল্পটা পড়তে পড়তে তুমি হারিয়ে যাবে আশ্চর্য এক পৃথিবীতে। আনন্দময়ী এই  পৃথিবীর প্রাচুর্য আর বিশালতা তোমাকে ছুঁয়ে যাবে বার বার। কিছু সময় নিয়ে বইগুলো পড়।  যা কিছু শেখার বা আহরণ করার করে নাও। সব থেকে বড় কথা তুমি বইগুলো পড়ে আনন্দ পাবে।  তোমার জীবন যে পথেই যাক না কেন অনাগত দিনগুলোতে এই  নির্মল আনন্দ তোমার কাছে ফিরে ফিরে আসবে শতগুণে । বার  বার । এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । এই পাঠ পরিক্রমা তোমার হাজারো  দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-বিষাদের,এই সব দিনরাত্রি থেকে অনেক বেশী তাৎপর্যপূর্ণ  ।

      যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় আমি এই অনন্ত নিঃসঙ্গ নির্মাণের দীক্ষা পেয়েছি কোথায় ? উত্তরে আমি দুটি মাত্র নাম বলব, একজন এই কবি জ্যাকবসন আর অন্যজন অগাস্টি র‌্যদাঁ, সেই অনন্য ভাস্কর, সমসাময়িক শিল্পীদের মাঝে যিনি প্রবাদ প্রতিম।

তোমার  এই পথচলা  সফল হোক।
                                                                    
তোমারই,                                                         
রাইনের মারিয়া রিলকে

রাইনের মারিয়া রিলকে : নবীন কবিকে লেখা চিঠি -১


ছায়া অনুবাদ: দেবব্রত আচার্য 


 

( রাইনের মারিয়া রিলকে চিঠিগুলো লিখেছিলেন ২৭ বছর বয়সে,  এক কবি যশোপ্রার্থী ১৯ বছরের বালককে। যা Letters to a Young Poet ( মূল জার্মান নাম : Briefe an einen jungen Dichter) নামে ছাপা হয়। নিচে প্রথম চিঠিটির ছায়া অনুবাদ। এক একে বাকিগুলো ও অনুবাদ করার ইচ্ছে রইল। )

 

প্যারিস,
ফেব্রুয়ারী ১৭, ১৯০৩
 প্রীতিভাজনেষু, 

        তোমার চিঠি কিছুদিন আগেই পেয়েছি। আমার ওপর তোমার আস্থার জন্য ধন্যবাদ। আমি একটি কাজ করতে পারি তোমার জন্য । তোমার কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি । সমালোচনা করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। সমালোচনার পরিসরে শিল্পকর্মকে খুব কমই ধরা সম্ভব হয়। এতে সৃষ্টি হয় অহেতুক ভুল বোঝাবুঝির । সব কিছুর যেমন অবয়ব দেয়া সম্ভব হয়না না তেমনি ভাষায়ও প্রকাশ করা যায় না।  এমন অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে যা প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। এই অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মনোজগতের এমন একটি স্তরে ঘটে,  যেখানে কোন ভাষা এখনও প্রবেশ করতে পারেনি। শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে সেটি আরো বেশি করে প্রযোজ্য। এই অভিজ্ঞতাগুলোর অস্তিত্ব বেঁচে থাকে শুধু মাত্র আমাদের স্বল্পমেয়াদী  জীবনের পরিসরে।

           উপরের এই সংক্ষিপ্ত কথাগুলো কে ভূমিকায় রেখে আমি কি বলতে পারি যে তোমার কবিতায় নিজস্ব কোন  রচনা শৈলি এখনো গড়ে ওঠেনি ।যদিও এতে একান্ত নিজস্ব, সুপ্ত একটা কিছুর নীরব যাত্রা শুরু রয়েছে বলে মনে হয় । তোমার শেষ কবিতা 'আমার আত্মা'য় এ ব্যাপারটি আরো স্পষ্ট করে চোখে পড়ে। সেখানে তোমার নিজস্ব কিছু উপলব্ধি শব্দ ও ছন্দ হয়ে উঠতে চাইছে মাত্র। তোমার 'লিওপার্ডীর প্রতি' কবিতায় বিশাল এক নির্জন  সত্তার প্রতি তোমার এক রকম সংযোগের প্রকাশ ঘটেছে । কবিতা গুলো নিজেরা তেমন কিছু হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনভাবে এরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি আপন মহিমায় । এমন কি তোমার শেষ কবিতাটি বা 'লিওপার্ডীর প্রতি' ও নয়। তোমার চিঠিতে তুমি যে ত্রুটি গুলোর কথা উল্লেখ করেছ সেগুলো পড়ার সময় আমি নিজেও বুঝতে পেরেছি। কবিতার নামগুলো এই মুহূর্তে যদিও মনে করতে পারছি না । 

              তুমি জানতে চেয়েছ কবিতাগুলো ভালো হয়েছে কিনা। আমাকে যেমনটি জিজ্ঞেস করেছ, তেমনি অন্যদেরও জিজ্ঞেস করেছ। পত্রিকায় পাঠিয়েছ কবিতাগুলো। অন্যের কবিতার সাথে তুলনা করেছ। সম্পাদকেরা তোমার কবিতা বাতিল করে দিয়েছে বলে কখনও মর্মাহত হয়েছ। এখন যখন তুমি আমার উপদেশ চাইছ তবে তোমাকে আমি একটি অনুরোধ করছি। এগুলো আর দয়া করে করনা । তুমি বাইরের দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে আছো। এটি এক্ষুণি তোমায় এড়িয়ে চলা উচিত। এ ব্যাপারে অন্য কেউ  তোমাকে উপদেশ দিতে বা সাহায্য করতে পারবে না। কেউ না । শুধু মাত্র একটি কাজ করতে পারো। নিজের দিকে ফিরে তাকাও। যা তোমাকে বাধ্য করে লিখতে সেই কারণটি খুঁজে বের করো। খুঁজে দেখ এই কারণটি তোমার হৃদয়ের কত গভীরে শেকড় ছড়িয়েছে । নিজেকে জিজ্ঞেস করো যদি তোমার জন্য লেখালেখি নিষিদ্ধ করা হয় তবে তার জন্য প্রাণ দিতে পারবে কিনা। নিজেকে রাতের একান্ত  নির্জনতায় জিজ্ঞেস করো,  "আমাকে কি লিখতেই হবে?" নিজের গভীর সত্ত্বার  কাছে গিয়ে এর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করো। যদি এই ভাবগম্ভীর প্রশ্নের উওর আসে তীব্রতর চিৎকারে, "হ্যা, আমাকে লিখতেই হবে" - তাহলে নিজের জীবনকে এর জন্য তৈরি করো। জীবনের প্রতিটা মূহূর্তে  উৎসর্গ করো। নগণ্য থেকে নগণ্যতম সময়গুলোও সাক্ষী থাকুক তোমার তীব্র অন্তর্দহনের । তারপর প্রকৃতির খুব কাছে যাও। পৃথিবীর প্রথম মানুষের চোখ নিয়ে দেখ প্রকৃতিকে। বলার চেষ্টা করো , তুমি কী দেখছো, কী অনুভব করছো,  কী  ভালোবাসতে পারছো আর কীইবা হারাতে চলেছ ? 

        প্রেম বা অতি সাধারণ কোন বিষয়ে লিখতে চেষ্টা করো না। এটা খুব কঠিন কাজ । যে বিষয়গুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক চমৎকার কাজ হয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে মৌলিক কিছু লিখতে গেলে প্রচণ্ড রকমের মুন্সিয়ানা চাই। যা আসতে পারে একমাত্র পরিণত হাতের ছোঁয়ায়। তাই এ বিষয়গুলো থেকে দূরে থেকো। লিখতে চেষ্টা করো তোমার দৈনন্দিন যাপিত জীবন। তোমার ছোট ছোট দুঃখ, ইচ্ছে, হঠাৎ  করে উড়ে আসা ভাবনা কিংবা সৌন্দর্য সম্পর্কে তোমার নিজস্ব বিশ্বাস। বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে লিখে যাও।যখন লিখবে তখন চারপাশের রীতিনীতি, স্বপ্নে দেখা চিত্রকল্প ও স্মৃতির সাহায্য নাও। যদি তোমার যাপিত জীবনকে আপাত পক্ষে দরিদ্র বলে মনে হয় তবে তাকে দোষ দিও না। দোষ নিজেকে দাও। নিজেকে বলো কবি হওয়ার গৌরব সে তোমার নয় । কারণ স্রষ্টার কাছে ধনী দরিদ্র বলে কিছু হয় না । নিজেকে কখনও খুঁজে পাও যদি জেলখানার চার দেয়ালের মাঝে; যেখানে পৃথিবীর অন্য কোন শব্দের প্রবেশ নিষেধ; সেখানেও কি তোমার সাথে থাকবে না শৈশবের অমূল্য সেই সোনালি দিনগুলো? সমস্ত শক্তি দিয়ে সেখানে মনসংযোগ করো। চেষ্টা করো সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই অনুভূতিগুলোর অনুরণন আবার নুতন করে অনুভব করতে। তাতে তোমার ব্যক্তিত্ব হবে আরো প্রখর। তোমার নির্জনতার পরিধি বিস্তৃততর হয়ে নিজেই পরিণত হবে বিশাল এক জগতে । সে জগতের সন্ধ্যালোকে তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে একা। অনেক দূর হতে চেনা অচেনা মানব-মানবীর কোলাহল তোমার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছুবে । এই একান্ত নগ্ন নির্জন জগতে হারিয়ে যেতে যেতে যদি কাব্যলক্ষ্মী তোমাকে ধরা দেন তবে ভাববার প্রয়োজন পড়বে না, তা ভাল না মন্দ। তুমি তোমার কাব্যলক্ষ্মীকে তখন আর পত্রিকায় পাঠাবে না । কারণ এটি  তোমার সৃজন । তোমার জীবনেরই একটা অংশ। তোমারই কণ্ঠস্বর।

        শিল্পকর্ম তখনই শিল্পমানে উন্নিত হয় যখন তা  অন্তর্নিহিত তাগিদ থেকে সৃষ্টি হয় । এই তাগিদ দিয়েই শিল্পকে আলাদা করে চেনা যায় । সুতরাং, আমি তোমাকে অন্য কোন উপদেশ দিতে অক্ষম। শুধু বলতে পারি নিজেকে জানো। আরো গভীরে প্রবেশ করো। বোঝতে চেষ্টা করো তোমার জীবন যা থেকে উৎসারিত তার গভীরতা। তোমাকে লিখতে হবে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরও আছে সেখানেই। সে উওর যেভাবেই আসুক তা মেনে নাও। তাকে পরিবর্তন করতে যেও না। হয়ত তুমি আবিস্কার করলে একজন কবি হওয়াই তোমার নিয়তি। তা হলে সেই নিয়তিকে মেনে নিয়েই পথচলা শুরু হোক। তার ভার, বিশালতা সবই গ্রহন করো, ফলের আশা ছেড়ে। কবির কাছে তার নিজস্ব একটা আশ্চর্য ভুবন থাকা চাই। কবি তাঁর সৃষ্টির সব উপাদান এই ভুবন থেকেই খুঁজে নেবেন । সে ভুবনের প্রতি কবির থাকবে সমস্ত জীবন উৎসর্গিত।

           তোমার অন্তপুরের নির্জনতায় প্রবেশ করে হয়তো জানতে পারলে কবি হওয়া তোমার কর্ম নয় ( যদি এক জন না লিখে বাঁচতে পারে তবে তার লিখার প্রয়োজন নেই )।  তারপরও এই নিজেকে খোঁজার অর্থ মিথ্যে হবে না তোমার । জীবন সেখান থেকেই সঠিক পথ খুঁজে নিবে। আমি আশা করছি এই নুতন পথও  হবে আরো বিস্তৃত। আমার শুভ কামনা রইল। 

           আর কি বলতে পারি বলো? ছোট ছোট টুকরো ঘটনার রয়েছে অসীম গুরুত্ব  ।অবশেষে আর একটা পরামর্শ তোমাকে দিচ্ছি । এগিয়ে যাও নীরবে। খেয়াল রেখো এই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে ক্ষতিকারক হতে পারে তোমার  নিজস্ব সত্ত্বার বাইরে গিয়ে তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা।। তোমার একান্ত নির্জন অব্যক্ত  অনুভুতির অতলেই  লুকানো রয়েছে সে উত্তর। 

        আমাকে যে কবিতাগুলো পাঠিয়েছিলে, সেগুলো ফেরত পাঠালাম । আমাকে বিশ্বাস করে প্রশ্নগুলো করার জন্য আবারো তোমাকে ধন্যবাদ। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি উত্তরগুলো সততার সাথে দেয়ার। আমার চেষ্টার মাত্রাটা হয়ত একজন অপরিচিত ব্যাক্তির থেকে তোমার প্রত্যাশাকে একটু ছাড়িয়েই গেছে ।

তোমার একান্ত, 
রাইনের মারিয়া রিলকে

রবিবার, ১৯ মে, ২০১৩

মাতৃভাষার মৃত্যু ও অন্যান্য

       পাঠক, ভাবুন আপনার মাতৃভাষা এমন একটি ভাষা যা একমাত্র আপনিই জানেন। এই বিশাল বিশ্বে আর কেউ নেই যিনি আপনার ভাষা বলতে বা বুঝতে পারেন। আপনার মৃত্যুর সাথে সাথে হাজার বছরের পুরোন পিতৃপুরুষের ভাষার ও মৃত্যু ঘটবে। এই ভাবনাটা ভয়ঙ্কর। এই সেদিন আন্দামানের আকা বো ( Aka Bo ) নামক একটি ভাষার শেষ কথোপকথনকারী মারা গেলেন। কী ভীষণ রকমের কষ্ট বুকে নিয়ে উনি এই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন তা ভাববার মতো মানসিক শক্তি আমার এই মুহূর্তে নেই। জীবিত থাকা অবস্থায় এই ভিডিওটি ধারণ করা হয়। দেখুনঃ

        আপনি যখন এই লেখাটি পড়তে পারছেন তখন ধরে নিচ্ছি আপনি একজন বাঙালী । আপনি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যাদের ভাষাটি এই মূহুর্তে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। আপনি এই লেখাটি পড়ার সময় প্রতি চৌদ্দ দিনে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের অতলে। সে সব মৃত ভাষা গুলোর স্থান হচ্ছে ধুলি ধূসর কোন এক সংগ্রহশালা। ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ভাষা পণ্ডিত আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, একুশ শতকের মধ্যেই পৃথিবী থেকে ৯০ শতাংশ ভাষা চিরতরে বিলুপ্ত হবে। ইউনেস্কোর মতে পৃথিবীতে প্রায় ৬০০০ ভাষা হারিয়ে যাওয়ার বিপদে রয়েছে। এই মূহুর্তে আপনার ভাষাটি যদিও হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই তার মানে এই নয় যে তা হারিয়ে যেতে পারে না। পরাক্রমশালী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষা মেসোডোনিয়ায় কথা বলেন এখন খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। পৃথিবীর প্রধানতম ধর্ম প্রণেতা যীশু যে-ভাষায় কথা বলতেন সেই ভূমধ্যসাগরীয় আরামাইক ভাষা ও প্রায় বিলুপ্তির পথে । এরকম অনেক উল্লেখযোগ্য ভাষাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।



ভাষা কি ও পৃথিবীতে কতটি ভাষা আছে?



        ভাষা একটি সচল ও ক্রম পরিবর্তনশীল সত্তা যা দিয়ে মানুষ শব্দ, চিহ্ন কিংবা শারিরিক অভিব্যক্তির সাহায্যে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে । ভাষার এই সচলতা ও ক্রম পরিবর্তনশীল চরিত্রের জন্য এর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ কঠিন কাজ। অনুমান করা হয় যে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০০ শতকে পৃথিবীতে প্রায় ২০০০০ সচল ভাষা ছিল। ভাষা পণ্ডিতদের মতে সেই সংখ্যা কমে বর্তমানে সচল ভাষা রয়েছে মাত্র ৬৫০০ । এই ভাষা গুলোর রয়েছে এক বা একাধিক মাতৃ ভাষাভাষী বক্তা (native speaker) । তাদের প্রথম ভাষা (first language ) হিসেবে এটি জন্মসূত্রে প্রাপ্ত।

কেন ভাষা হারিয়ে যায়?


       বিভিন্ন কারণে ভাষা হারিয়ে যেতে পারে। একটি অন্যতম কারণ নগরায়ণ ( urbanisation ) । আজকের এই গ্লোবালাইজড বিশ্বে অর্থনৈতিক কারণে প্রব্রজনের ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায় এক সাথে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। একটি কুকি ভাষাভাষী পরিবার এবং একটি চাকমা পরিবার যদি গৌহাটিতে অভিবাসী হয় তবে তারা হয়ত একে অন্যের সাথে সেখান কার কাজের ভাষা অসমিয়া বা হিন্দি তে কথা বলবে। সেই কুকি-চাকমা পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়তো মা-বাবার কাছ থেকে একটু আধটু মাতৃভাষা শিখবে, কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মে এসে সেই প্রাসঙ্গিকতাও হারাবে। মানুষ কেন নগরমুখী হয় তা নিয়ে অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। এই নগরায়ণ খুব দ্রুত পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের ভাষিক ল্যান্ডস্কেপ। নগরায়ণ থেকেও বিপদজনক কারণটি হল রাষ্ট্র নিজে। 

        ছোট ছোট জাতি সত্তা গুলো বার বার রাষ্ট্রের কাছে হারিয়েছে তার ভাষা ও সংস্কৃতি। এই সত্তা গুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়া হয় রাষ্ট্রের সাথে একাত্ম ( assimilate ) করতে । অস্ট্রেলিয়ার Stolen Generation এর কথা আমরা সবাই জানি। কিভাবে মায়ের কোল থেকে জোরপূর্বক আদিবাসী ( aboriginal) ছেলে মেয়েদের নিয়ে গিয়ে বদলে দেয়া হতো তাদের ভাষা সংস্কৃতি তা আজো অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়। ঠিক তেমনি ১৯৬১ সালে ভারতের আসাম সরকার, আসামের সংস্কৃতি ও ভাষিক বৈচিত্র্য কে নষ্ট করে দিতে প্রচেষ্টা চালিযে ছিল। যার প্রতিবাদে ১৯ মে এগারো জন শহিদ হয়েছিলেন আসামের শিলচরে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যুগেযুগে বিভিন্ন ভাবে ভাষিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে সচেতন ভাবে। উপনিবেশিক শক্তির যাঁতাকলে পরে ও হারিয়ে গেছে অনেক ভাষা-সংস্কৃতি । আমাদের এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী ক্রমেই একমাত্রিক হয়ে ওঠার চেষ্টায় ব্রতী। সংস্কৃতি ও ভাষিক বৈচিত্র্য ( cultural and linguistic diversity ) হারিয়ে দেশে দেশে তৈরী করা হচ্ছে হ্যারি পটার প্রজন্ম। এ প্রজন্ম না পারছে চিনে নিতে নিজের সংস্কৃতি, না পারছে অন্য সংস্কৃতি কে শ্রদ্ধা করতে। ভুলতে বসেছে যে নিজে কে জানার মাঝেই লুকিয়ে আছে অন্যকে জানার ও সম্মান করার চাবিকাঠি।

       এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ইন্টারনেটে ইংরেজী ভাষার আধিপত্য অন্যান্য ভাষার প্রচার ও প্রসারকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কিছু কিছু ভাষার মিডিয়া মনোপলি অপেক্ষাকৃত ছোট ভাষাগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে বিপরীত ভূমিকা পালন করছে। শিশুরা ভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র, কার্টুন যাই দেখুক না কেন, সে ভাষা ক্রমে তার মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে । তারা ক্রমে শিখে ফেলে সে ভাষা এবং এক সময় সে ভাষা ব্যবহারও করে। আর এভাবে ব্যবহার করতে করতে এক সময় ভুলে যায় পিতৃপুরুষের ভাষা। দূর্বল হয়ে পড়ে পারিবারিক যোগসূত্র (লিঙ্ক) । তৃতীয় প্রজন্ম ( নাতি) বুঝতে পারে না প্রথম প্রজন্মের ( দাদু ) ভাষা। যদিও বা যোগসূত্রটুকু থাকে তাও হয়ে পড়ে ভীষণ রকম নড়বড়ে।


ভাষা হারিয়ে গেলে কি হয়?


       সংস্কৃতি ( culture ) বলতে আমরা বুঝি আমাদের সামগ্রিক জীবন যাপন প্রক্রিয়া যা হাজার হাজার বছরের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় পিতৃপুরুষের হাত ধরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে । বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এই জীবনযাপন প্রক্রিয়া আলাদা। আর সেই আলাদা বিশ্বাস,মূল্যবোধ ও জীবনযাপন প্রক্রিয়া দিয়েই চেনা যায় তাদের আলাদা করে । মূলত সেটাই তাদের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় ( ethnic identity )। সেই পরিচয়ের মৌলিক একটা উপাদান হলো ভাষা। সংস্কৃতি প্রকাশের আধার এটি। আমাদের বিশ্বাস,মূল্যবোধ ও জীবন যাপন প্রক্রিয়া এর দ্বারা প্রবাহিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। আমাদের সামগ্রিক পরিচয় ও সংহতির ধারক ও বাহক ভাষা। আমরা যেহেতু সেই সমগ্রের অংশ তাই ভাষা আমাদের আত্ম পরিচয়ের অংশও বটে। ভাষার মৃত্যু মানে সেই সংস্কৃতি ও পরিচয়ের মৃত্যু।

আসুন নিজ নিজ মাতৃভাষা কে তার উপযুক্ত সম্মান দেই। নিজের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের মৃত্যুকে প্রতিরোধ করি।

সোমবার, ১৩ মে, ২০১৩

কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী ( ১৯৩৭ - ২০০৫ )

সপ্তডিঙা মধুকর চারিদিকে জল
শ্রাবণের অবিশ্রাম মনসা-মঙ্গল
পচা পাটে এঁদো ডোবা বিষধর ফণা
ছেঁড়া কাঁথা-কাণি আর বাহুলা-যন্ত্রণা
হু হু করা কালসন্ধ্যা ভেসে আসা গানে
সায়ের ঝিয়ারি যায় অনন্ত ভাসানে ।
কোথায় নিছনি কোথা চম্পক-নগর
সাতনরী শিকা ঝোলে ঘরের ভিতর
কুপিলম্পে রাতকানা নিরক্ষরা বুড়ি
লখা’র মরণে কান্দে আছুড়ি-পিছুড়ি
জাল-টানা ছেলে আজ রাতে গেছে জলে
রেখো মা মনসা তার সর্বাঙ্গ কুশলে ।
গাঙের গর্ভিণী সেই গন্ধ ভেসে আসে
শ্রাবণীর দিগম্বরা দখিনা বাতাসে
এখনো বুকের দ্বিজ বংশীদাস কহে
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কালীদহে…
ডহরের ঘোর-লাগা গহনের টানে
সায়ের ঝিয়ারি যায় অনন্ত ভাসানে ।

পু ন র্মি ল ন 🍂

  দেখা হলো মুঠোফোনে! 'জীবন গিয়েছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার'! না তার থেকেও বেশী হবে? ফিরে ফিরে আসে কাঠালতলা-কুসুম ভোর, মনপড়ে বয়েস হোষ্ট...