পিসার নিকটে ( ইতালি )
এপ্রিল ৫, ১৯০৩
তোমার ২৪শে ফেব্রুয়ারি লিখা চিঠির উওর আজই দেয়া সম্ভব হচ্ছে । অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের জন্য ক্ষমা প্রার্থী । বেশ কিছুদিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপে কাবু হয়ে পড়েছি ।বলা যায় কার্যত আমাকে অচল করে দিয়েছে । শেষ পর্যন্ত দক্ষিণের সমুদ্র তটে হাওয়া বদলে এসে চেষ্টায় আছি শরীরটাকে একটু সুস্থ করার। আগেও এখানে একবার এসেছিলাম এমনি শরীর খারাপ নিয়ে। সেরেও উঠেছিলাম সে বার । এই অসুস্থতা হেতু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বড় করে চিঠি লিখা সম্ভব হবে না। লেখাটা এই মুহূর্তে বেশ কষ্টকর কাজ আমার জন্য।
তোমার চিঠি যেমনি আমাকে আমোদিত করে, তেমনি আমার উওর গুলো পড়তে পড়তে তুমিও নিশ্চয় হারিয়ে যাও । হয়ত বা তোমাকে কখন কখন সেগুলো নিরাশ করে। সত্যি বলতে কি জীবনের সবচেয়ে সুগভীর বিষয়গুলোতে আমরা সবাই ভীষণ রকমের একা। অনেক কিছু ঘটে যাওয়ার পর, অনেক পথ হেঁটে , সহস্র নক্ষত্র ঘটনার সাক্ষী হয়ে তবেই একজন মানুষ পারে অন্য এক মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে। সাহায্য করতে।
তোমাকে আজ দুটি জিনিস বলতে চাই:
এক.
আয়রনী : একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে । তোমার সৃষ্টি সত্তা কে কখন এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দিও না। বিশেষ করে যখন ভালো কিছু লিখতে পারছো না; তখন আয়রনী আশ্রয় নিতে যেওনা । অন্যদিকে যখন তুমি পুরো মাত্রায় সৃজনশীল , তখনই এটিকে ব্যাবহার করতে পারো অন্য এক বাচনভঙ্গি হিসেবে। যদি বিশুদ্ধতার সাথে একে ব্যবহার করা যায় তবে আয়রনীও বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। এতে লজ্জার কিছু নেই। যদি এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার তোমাকে চিন্তিত করে তুলে তবে অন্য কোন মহৎ কিংবা সিরিয়াস বিষয়ে মনোনিবেশ করো। যাতে নূতন এই বিষয়ের সামনে আয়রনী কে নিতান্তই ছোট আর অসহায় মনে হয়। বস্তুর গভীরে গিয়ে খোঁজো । তারপর ও যদি তোমার লেখায় আয়রনী থেকে যায় তা হলে ধরে নিতে হবে তোমার জীবন কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যসব মহৎ ও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কাজ করতে করতে হয়ত এটা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে ( যদি এটি সাময়িক ভাবে এসে থাকে ) । আর যদি এটি তোমার ব্যক্তি স্বতন্ত্রতার সাথে একীভূত হয়ে থাকে তবে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে । শিল্প-সৃষ্টির নূতন এক হাতিয়ার হিসেবে যুক্ত হবে তোমার ঝুলিতে।
দুই.
চারপাশের হাজারো বইয়ের ভীরে, কটা বই আছে যাদের ছাড়া আমার চলে না । তার মধ্যে দুটি বই আমার সাথে সব সময়ই থাকে। যেখানেই যাই না কেন, বই দুটি আমার সঙ্গে যায়। এর একটি হল বাইবেল আর অন্যটি ডেনিশ কবি জেন্স পিটার জ্যাকবসনের লিখা। তুমি উনার লেখা পড়েছ ? জ্যাকবসনের লেখাগুলো খুব সহজেই তুমি সংগ্রহ করে নিতে পারবে । রিক্লেমস ইউনিভার্সাল লাইব্রেরি তার বেশ কটি বইয়ের সাবলীল অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে । তার 'ছয়টি ছোটগল্প' এবং ‘নিলস লিহনি’ নামক উপন্যাসটি সংগ্রহ করে নাও । গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ম্যাগনেস’ থেকে পড়া শুরু কর। গল্পটা পড়তে পড়তে তুমি হারিয়ে যাবে আশ্চর্য এক পৃথিবীতে। আনন্দময়ী এই পৃথিবীর প্রাচুর্য আর বিশালতা তোমাকে ছুঁয়ে যাবে বার বার। কিছু সময় নিয়ে বইগুলো পড়। যা কিছু শেখার বা আহরণ করার করে নাও। সব থেকে বড় কথা তুমি বইগুলো পড়ে আনন্দ পাবে। তোমার জীবন যে পথেই যাক না কেন অনাগত দিনগুলোতে এই নির্মল আনন্দ তোমার কাছে ফিরে ফিরে আসবে শতগুণে । বার বার । এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । এই পাঠ পরিক্রমা তোমার হাজারো দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-বিষাদের,এই সব দিনরাত্রি থেকে অনেক বেশী তাৎপর্যপূর্ণ ।
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় আমি এই অনন্ত নিঃসঙ্গ নির্মাণের দীক্ষা পেয়েছি কোথায় ? উত্তরে আমি দুটি মাত্র নাম বলব, একজন এই কবি জ্যাকবসন আর অন্যজন অগাস্টি র্যদাঁ, সেই অনন্য ভাস্কর, সমসাময়িক শিল্পীদের মাঝে যিনি প্রবাদ প্রতিম।
তোমার এই পথচলা সফল হোক।
তোমারই,
রাইনের মারিয়া রিলকে
প্রথম চিঠিটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন