রবিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৮

বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্বঃ ইতিহাসের ইঙ্গিত

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের বৈশাখী মেলাটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঙালির মিলনমেলা। প্রতি বছরই মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকি। এই বর্ষবরণের মেলাটি হয় অলিম্পিক পার্কের বিশাল এএনজেড স্টেডিয়ামে। এ উপলক্ষে শুধু সিডনি-ক্যানবেরাই নয়, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি বহির্দেশ থেকেও বাঙলীরা আসেন সিডনিতে। প্রবাসে দুই বাঙলার মানুষ মিলে মিশে আনন্দে মেতে উঠেন। এতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে আসেন নামি দামি শিল্পীরা। লোকে টিকেট কেটে মেলা দেখে। গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে বিভিন্ন পণ্যের স্টল বসে। নানা রকমের সুস্বাদু খাবার, বই, পোশাক থেকে শুরু করে নানা প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকে মেলা প্রাঙ্গণে। আমার প্রিয় স্টলগুলি হল বইয়ের। অ্যামাজন কিন্ডেলের ই-বুকের তালিকায় বাংলা বইগুলি এখনো যায়গা করে নিতে পারেনি। তাই বাংলা বইয়ের জন্য ছাপা বই-ই ভরসা। এবার মানে ২০১৮-র মেলায় অনেক গুলো বইয়ের মাঝে নজরে পড়ল নীহাররঞ্জন রায়ের 'বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব'। মনে পড়ল নিজের ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙালির অনুসন্ধিৎসাহীনতা দেখে,  নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিকে বলেছিলেন আত্মবিস্মৃত জাতি। যাপিত জীবনের নির্দিষ্ট কালখণ্ডের মধ্যে বাঙালি বেঁচে থাকে, তারপর একদিন টুপ করে মরে যায় । বইটি কিনতে গিয়ে মনে মনে ভাবছিলাম নীরদ সি চৌধুরীর কথা সত্যি প্রমাণ করে অন্য অনেক গুলো রেফারেন্স বইয়ের মাঝে এটিও হয়ত পরে রইবে আমার বইয়ের তাকে। কিন্তু তা হলো না। একবার হাতে নেয়ার পর আর তুলে রাখা গেলো না বইটি। 'কোথা হইতে আসিয়াছ, নদি?’ এই প্রশ্নের ন্যায় আমারও জানতে ইচ্ছে হলো বাঙালির হাজার বছরের পথপরিক্রমার ইতিহাস। 

নাম থেকেই আঁচ  করতে পারি এটি বাঙলার রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস নয়। বাঙালির ইতিহাস। বাঙালি নরগোষ্ঠীর ইতিহাস। এই ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক মণিমুক্তা। লেখক আমাদের শিহরিত করেন, বাঙালি জীবনের ছোটখাট রীতি-নীতি, রেওয়াজ, উৎসব-পার্বণের সাথে পরিচয় করিয়ে  দিয়ে,  যা হাজার বছর পরও প্রায় অপরিবর্তিত হয়ে রয়ে গেছে আমাদের সমকালীন জীবনে। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের সাথে তাই একমত না হয়ে পারি না। তিনি বলছেন, 'ইতিহাসের কথা ছাড়িয়া, ভাষা ও সাহিত্যের দিক হইতেও সমগ্র বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে ইহা একটি অনন্যপূর্ব গ্রন্থ'। আর একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রবোধচন্দ্রের মতে,  'এটি বাংলার প্রাচিন ইতিবৃত্ত বিষয়ক শেষ বই এবং বাংলার ইতিবৃত্ত সাধনার চরম পরিণতি ঘটেছে এটিতেই'। নীহাররঞ্জন রায় নিজেই  স্বীকার করছেন এই বইয়ের তথ্য ও উপাদানে নূতন কিছু নেই।  তিনি নিজে এর কিছুই আবিষ্কার করেননি। শুধু প্রাচীন বাঙলার ও বাঙালির ইতিহাস এক নূতন কার্যকারণসম্বন্ধগত যুক্তিপরস্পরায়, এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই বইটি হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য।

 বইটির সময়কাল মুসলমান দ্বারা বাঙলা বিজয় পর্যন্ত। এই সময়কালের মধ্যে প্রাচীন বাঙলার ভৌগলিক সীমা, ধন-সম্পত্তি, শস্য উৎপাদন পদ্ধতি, ভূমি, বর্ণ, শ্রেণী, রাষ্ট্র, রাজবৃত্ত, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা ও সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্পকলা সহ বাঙালি জীবনের প্রায় সব কটি বিষয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন অসাধারণ পাণ্ডিত্যে।

শেষ অধ্যায়ে এসে নীহাররঞ্জন বলেন, 'এই সুবিস্তৃত তথ্যবিবৃতি ও আলোচনার ভিতর হইতে ইতিহাসের কোন কোন ধারা সরু মোটা রেখায় সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে, নিরবচ্ছিন্ন সমগ্র প্রবাহটির কোথায় কোন বাঁকে দৃষ্টিগোচর হইতেছে, এই সুবিস্তৃত কালখণ্ড পরবর্তী কালখণ্ডের জন্য কী কী বস্তু উত্তরাধিকার স্বরূপ রাখিয়া যাইতেছে, ভবিষ্যতের কোন নির্দেশ দিয়া যাইতেছে, এক কথায় এই সুবৃহৎ গ্রন্থ ভেদ করিয়া ইতিহাসের কোন ইঙ্গিত ফুটিয়া উঠিতেছে, গ্ৰন্থশেষে একটি অধ্যায়ে তাহার আলোচনা উপস্থিত করা হয়তো অসঙ্গত নয়’। মেধাবী হাতে তারপর তিনি লিখে যান বাঙালির ইতিহাসের সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহটির সুস্পষ্ট ইঙ্গিতের কথা। যা এই নরগোষ্ঠীর গর্বিত উত্তরাধিকার। কি সেই উত্তরাধিকার? এই অধিকার বাঙলার পলি মাটির মতই কোমল প্ৰাণধর্ম ও হৃদয়াবেগের উত্তরাধিকার। একই সাথে প্রতিবাদ প্রতিরোধেরও। বাঙালির সাথে মধ্যগাঙ্গেয় সনাতনত্বের বিরোধ দেখিয়ে দিয়ে লেখক বলেন, 'শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞানচর্চায় বুদ্ধি ও যুক্তি অপেক্ষা প্ৰাণধর্ম ও হৃদয়াবেগের প্রাধান্য; বাঙলার পরিবার ও সমাজবন্ধন প্রভৃতি সমস্তই আৰ্যমানসের দিক হইতে বৈপ্লবিক ও সনাতনত্বের বিরোধী। দুঃসাহসী সমন্বয়, স্বাঙ্গীকরণ ও সমীকরণ যেন বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; সনাতনত্বের প্রতি একটা বিরাগ যেন বাঙলার ঐতিহ্য ধারায়। ইহার মূল প্রধানত বাঙালির জনগত ইতিহাসে, কিছুটা তাহার ভৌগোলিক পরিবেশে, তাহার নদনদীর ভাঙা গড়ায়, কিছুটা ইতিহাসের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যে।' 

বাংলাভাষী জনসাধারণের হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতার কথা উল্লেখ করে লিখেন, 'প্রাচীন বাঙালির হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতার ইঙ্গিত তাহার প্রতিমা-শিল্পে এবং দেব-দেবীর রূপ-কল্পনায় ধরা পড়িয়াছে'। তিনি আরও বলেন, 'এই হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতা যে বহুলাংশে আদিম নরগোষ্ঠীর দান, তাহা আজিকার সাঁওতাল, শবর প্রভৃতির জীবনযাত্রা, পূজানুষ্ঠান, সামাজিক আচার, স্বপ্ন-কল্পনা, ভয়-ভাবনার দিকে তাকাইলে আর সন্দেহ থাকে না।'

বাঙালি জাতি বরাবরই সনাতন আর্যধর্মের বিপরীতে গিয়ে নিজের হৃদয়াবেগকে সবার উপরে স্থান করে দিয়েছে। নীহাররঞ্জন রায়ের কথায়, 'আর্য-ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ ও জৈন সাধনাদর্শে কিন্তু এ ঐকান্তিক হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতার এতোটা স্থান নাই। সেখানে ইন্দ্রিয়ভাবনা বস্তু-সম্পর্ক-বিচ্যুত; ভক্তি, জ্ঞানানুরাগ ও হৃদয়াবেগ বুদ্ধির অধীন। বস্তুত বাঙালির অধ্যাত্মসাধনার তীব্র আবেগ ও প্রাণবন্ত গতি সনাতন আর্যধর্মে অনুপস্থিত।'

দেবতাদের সাথে বাঙালির সম্পর্ক নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, 'মধ্যযুগে দেখিতেছি, দেবই হউন আর দেবীই হউন, বাঙালি যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে তাহাদের মর্ত্যরে ধুলায় নামাইয়া পরিবার-বন্ধনের মাধ্যেমে বাঁধিতে এবং ইহগত সংসার-কল্পনার মধ্যে জড়াইতে, হৃদয়াবেগের মধ্যে তাহাদের পাইতে ও ভোগ করিতে, দূরে রাখিয়া শুধু পূজা নিবেদন করিতে নয়।'

আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতির নিজেদের আয়ুষ্কালের বাইরে গিয়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানকে দেখার মাঝে আশার আলো দেখতে পাই। 'আপনারে চিনতে পারলে যাবে অচেনারে চেনা'। প্রবাসে বসে বাঙালির ইতিহাস পড়তে পড়তে এই ধারনাটি আরও বেশি পোক্ত হয়।

পু ন র্মি ল ন 🍂

  দেখা হলো মুঠোফোনে! 'জীবন গিয়েছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার'! না তার থেকেও বেশী হবে? ফিরে ফিরে আসে কাঠালতলা-কুসুম ভোর, মনপড়ে বয়েস হোষ্ট...