বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২২

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়

কারা যেন বাড়ি করছে গগন চুম্বী আশায়

আমি তখন ব্যস্ত থাকি আরেক ভালবাসায়।

 

কলেজ রোড পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলে রাস্তাটা দু দিকে চলে গেছে। এক দিকে বিবেকানন্দ রোড। অন্যদিকে সৎসঙ্ঘ আশ্রম রোড। আশ্রম রোডটা একটু পেরিয়ে রাস্তার বা দিকে চলেগেছে একটা কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে হাতের ডান দিকে কবির ছোট্ট বাড়ি। তাঁরই এক কোণে চিতপটাং শুয়ে লিখে যেতেন সময় শরীর হৃদয়ের পঙক্তিমালা। তাঁর ভাষায় রাংতা করতেন সোনা। এটাই কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী অনাড়ম্বর জীবনের আপাত ঠিকানা।

সালটা ১৯৯৪। তখন সবে স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে জিসি কলেজে পা রেখেছি। আমদের বরাক উপত্যকার বহু কাঙ্ক্ষিত আসাম বিশ্ববিদ্যালয় গুটি গুটি পায়ে তাঁর পথ চলা শুরু করেছে। বন্ধুদের বৈকালিক আড্ডায় সুস্মিতা সেন মিস ইঊনিভার্সের খেতাব পেয়ে তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আমাদের চোখেমুখেও পৃথিবীটা পাল্টে দেয়ার স্বপ্ন। একটু আধটু লেখালেখিও করছিএখানে ওখানে ছাপা হরফে নিজের নামটা দেখতে পাচ্ছি। পড়ার টেবিলে পাঠ্য বইয়ের থেকে বেশি জমা হয়েছে গল্প কবিতার বই। নিয়মিত যাই প্রেমতলার বইয়ের দোকান আবাহনে। বই কেনার সামর্থ্য না থাকলেও নেড়ে চেড়ে দেখি হরেক রকম বই। তখনো ইন্টারনেট আসেনি আমাদের শিলচর শহরে। তাই আবাহন আর বইয়ের দোকানগুলোই ছিল আমাদের এই প্রান্তিক জনপদের সাথে বাইরের বিশাল বিশ্বের যোগসূত্র। সেই সময়টাতেই কোন এক ছুটির দুপুরে আমার স্কুল শিক্ষক প্রসূন কান্তি দেবের আদেশে সাইকেলে প্যাডেল মারতে মারতে চলে এলাম শক্তি স্যারের বাড়ি। এর আগে কলেজে স্যারের বেশ কটা ক্লাস করে ফেলেছি। প্রথম দেখায় এই মানুষটাকে আর যাই হোক কবি বা অধ্যাপক বলে কিছুতেই মনে হয়নি। মনে হয়েছিল রিটায়ার্ড কোন আর্মি অফিসার। ‘নেভার জাজ এ বুক বাই ইটস কভার’, কারণ ‘লুক ক্যানবি ডিসিবটিভ’। এই আপাত কঠিন চেহারার মানুষটার ভেতরে যে বইছে ভালোবাসার ফল্গুধারা, সে কথা যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাদের টের পেতে বেশি দেরি হয়নি। 

আমার এই কবি স্যার কখনো কাউকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। কিন্তূ আজ গর্ব করে বলতে পারি আমি পড়েছিলাম। প্রাইভেট পড়ার বাহানায় স্যারের কাছকাছি আসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বাংলা ছন্দের পাঠ আমার শক্তি স্যারের থেকেই নেয়া। কবিতার কী কেন তাঁর কাছে থেকেই জেনেছিলাম সেই প্রথম যৌবনে। দুই অসম বয়সী শিক্ষক-ছাত্রের ছুটির রবিবারের আড্ডায় উঠে এসেছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মানচিত্র, কাঁটাতার, দেশভাগ। তিনি বলতেন, আমি শুনতাম। স্যার ছিলেন ভিষণ আড্ডা প্রিয়, অহমিকাহীন, সরল, নিপাট এক ভাল মানুষ

এই ছুটির দুপুরে প্রাভেট পড়া দিয়ে শুরু, কিন্তু স্যারের সাথে আমার সম্পর্ক আরও গভীরতা পায় পরবর্তী সময়ে। এক দিন বললেন উনার মেয়ে কপোতাক্ষীবিয়ে। আর আমার দায়িত্ব হলো চিঠি বিলি করা। নিমন্ত্রিত শহরের সব বিশিষ্ট বিদ্যজন শহরের ছোট বোড় অলিগলি ঘুরে বিয়ের চিঠি বিতরণ করতে করতে চেনা হয়ে গিয়েছিল শিলচরের অনেক বিখ্যাত মানুষের বাড়ি। মনে পড়ে দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ পত্রিকার সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরীর মালুগ্রামের বাড়িতে তাঁর হাতে কপোতাক্ষীদির বিয়ের চিঠিটা তুলে দিয়েছিলাম আমি। সবাই মিলে খুব আনন্দ করেছিলাম বিয়ের অনুষ্টানেখুব সুন্দর একটা শীতের রাত ছিল।শিলচরের বৃষ্টি বাদলহীন বিয়ের মৌসমের এই সময়টা আমার বড় ভাললাগার। মনে পড়ে হাইলাকন্দি থেকে আসা কবি বন্ধু সুজিৎ ভট্টাচার্য পুত্র লালনদার সাথে খুব ভাব হয়ে ছিল সেই বিয়েতে। সবই আজ স্মৃতি।

শিলচরে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে রুজি রোজগারের আশায় অনেকের মত দূরপাল্লার ট্রেনে চড়ে মহানগরের পথে পাড়ি দিয়েছি প্রায় দুই যুগ আগে কিন্তু এখনো স্মৃতিতে ভর করে ছুঁতে পারি সেই ফেলে আসা দিনগুলি। আমাদের আমির গড়ে উঠার সময় সেটা। মনে পড়ে স্যারের লেখা আর সান্নিধ্য আমাকে এতোটাই আলোড়িত করেছিল যে বাড়ি ফিরেই গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজার মতো করে, লিখে ফেলেছিলাম নিচের কবিতাটি স্যার কে উৎসর্গ করে।

 

আপনি জন্মেছিলেন এমন একটি গ্রামে

যেখান থেকে শহর ছিল পঁচিশ মাইল দূরে

গ্রামের নামটি ভীষণ ‘অকাব্যিক, অনর্থক ও বিচ্ছিরি’

তাই জানাতে সংকোচ, তবু ভাল, তবু প্রিয়।

আপনার শৈশব ঘিরে ছিল একটি নদির গ্রন্থনা

নদীর নামটিও ভীষণ অবিশ্বাস্য, বিবিয়ানা।

 

আজ প্রায় মধ্যবয়সে সূদুর অস্ট্রেলিয়ায় বসে আমিও খোঁজে ফিরি প্রিয় নদী বরাক-জিরি-চিরি। ফারাক একটাই আমাদের প্রজন্ম দেশান্তরী হচ্ছে অর্থনীতিক কারণে আর শক্তি স্যারের প্রজন্ম পেছনে ফেলে এসেছিলেন সব দেশভাগের কারণে। আমাদের কারো আর বাড়ি ফেরা হয়নি। আর হবেও না হয়ত।

 

 শক্তি স্যারের চলে যাওয়ার দিন বা তাঁর আশে পাশের সময়টাতে দিল্লীতে ছিলাম আমি।  খবরটা পাই ফোনে প্রসূন স্যার মারফত। ইন্টারনেট ঘেটে জানতে পারি শিলচরের মানুষ তাঁর শেষ যাত্রায় তাকে ভালোবাসায় ভাসিয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি। কবির শহর শিলচরের মানুষ উপছে পরেছে তাদের প্রিয় কবির অন্তিম যাত্রায়।     

 

আমার ঈশ্বর নেই, আত্মা নেই, পরমাত্মা নেই

স্বর্গ ও নরক নেই, পুনরায় ফিরে আসা নেই

জন্মে গেছি এই সত্য, মরে গেলে ঘাসে ও মাটিতে

জলে ও বায়ুতে মিশে যাব, এর বেশি অভিপ্রায় নেই।

 

কবি সেই কবে ঘাসে ও মাটিতে, জলে ও বায়ুতে মিশে গেছেন কিন্তু আমাদের মেধা ও মননে আজ তাঁর কীর্তির অনুরণন শুনতে পাই। প্রায় দশ বছর আগে স্যারকে বরাক উপত্যকার বাইরের বোদ্ধা পাঠকের কাছে নিয়ে যেতে একটি ফেইসবুক পেইজ খুলেছিলাম, যা আমি ও কবি পুত্রী কপোতাক্ষীদি দুজনে মিলে এখনো চালিয়ে যাচ্ছি। দেশ বিদেশের অনেক মানুষ জুড়েছেন সেই ফেইসবুকের পাতাসেখানে তাঁর পাঠক আজও খোঁজ করেন তাঁর কবিতারজানতে পারি তাঁর কাজ নিয়ে গবেষনা হচ্ছে দেশ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে। এইতো সেদিন বিখ্যাত কবি মলয় রায়চৌধুরী পেজে কোন আপডেট না দেখে জানতে চাইলেন পেইজে কেন কোন আপডেট নেই। কবিকে ঘিরে এই ছোট ছোট ঘটনাপ্রবাহ তা আমাদের উৎসাহিত করে।

 

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম শক্তি স্যারের বাড়িতে যাওয়ার জন্য যিনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন তিনি হলেন আমার প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক প্রসূন কান্তি দেব। পাবলিক উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালিন সময়ে যার স্নেহ মমতায় বেড়ে উঠেছিলাম। শ্রেণীকক্ষে ও তার বাইরে তিনিই ছিলেন আমার সত্যিকারের অভিভাবক। আমার আর এক শিক্ষক অধ্যাপক বিশ্বতোষ চৌধুরী, আমার বিয়ের অনুষ্টানে এসে বলেছিলেন, “আজ প্রসূন বাবুর দুই ছেলের বিয়ে, একজন দেবব্রত আর অন্যজন পূন্যব্রত”। প্রসঙ্গত প্রসূন স্যারের ছেলে পূন্যব্রত আর আমার বিয়ের তারিখ একই দিনে ছিল। তেমনি ছিল আমাদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গভীরতা। যাই হোক, শক্তি স্যার আর প্রসূন স্যার ছিলেন বয়সের দিক দিয়ে সমবয়সী, দুইজনের জন্ম অবিভক্ত ভারতের শ্রীহট্টে।

 

এখন ভূভারতে শ্রীহট্ট নামে কোন জেলা নেই

এখন আমাদের জেলার নাম কাছাড়

আমাদের পশ্চিমের জেলার নাম করিমগঞ্জ

তারও পশ্চিমে একটা জেলার নাম সিলট মানে সিলেট”

 

সেই শ্রীভুমি শ্রীহট্টের দুই কৃতি সন্তান শিলচর শহরকে দেশভাগের পর আপন করে নিয়েছিলেন। আজ তাদের দুজনের কেউই নেই কিন্তু তাদের মেধা ও মহৎ কাজের মাধ্যমে এই প্রান্তিক জনপদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জন্য তাদের প্রচেষ্টা সেটা আজীবন স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে আমাদের মত গুনমুগ্ধদের কাছে। একটা জনপদ মানে শুধু তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান নয়। একটা জনপদ মহান হয়ে উঠে তাঁর সাহিত্য, সংস্কৃতি আর মানবিক উৎকর্ষতায়। ভাবছেন শক্তি স্যারের কথা বলতে গিয়ে কেন প্রসূন বাবু কে টেনে আনলাম। তাঁর কারণ তাদের দুজনের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব, যা আজকাল আর চোখে পড়ে না। এখন যখন দেখি মানুষ মানুষে দূরত্ব বাড়ছে। হচ্ছে রাজনৈতিক মেরুকরনসেই সময়ে দাঁড়িয়ে আমার খুব মনে পছে এই দুই মহান ব্যাক্তির ঈর্শনীয় বন্ধুত্ব। একজন ছিলেন পাক্কা কমিউনিষ্ট আর অন্যজন ধর্মঅন্ত প্রাণ। একজনের প্রভাবে ছুটে গিয়েছিলাম রামকৃষ্ণ মিশনে আর অন্য জনের প্রভাবে দেখতাম দিন বদলের স্বপ্ন। একেই বলে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। শক্তি স্যারের জীবিত কালের সব থেকে শেষের যে বইটি প্রকাশিত হয়ে ছিল তাঁর নামও ছিল সম্ভবত দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। শক্তি স্যার এই বইটি উৎসর্গ করেছিলেন বন্ধু প্রসূনকে। উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলেন, “বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট সংস্কৃতি সেবী ও সাহিত্যমনস্ক ব্যক্তিত্ব শ্রী প্রসূন কান্তি দেব প্রিয় বরেষু”। তাদের রাজনীতিক বা ধর্ম বিশ্বাস কখনোই তাদের বন্ধুত্বের মাঝে দেয়াল হয়ে ওঠেনি। যৌথ ভাবে কাজ করে গেছেন বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন কে বরাক উপত্যকার আত্মপরিচয়ের প্রতিনিধিত্বশীল সংঘঠন হিসেবে গড়ে তুলতে।

 

দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন

কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল ‘এই যে ঈশান কোণ—

কোন ভাষাতে হাসে-কাঁদে কান পেতে তা শোন’

 

আজ বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন অনেক বড় সংঘঠন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নেতৃত্বে এই সংঘঠন গড়া তাঁরা আমাদের নমস্য।

জীবনের শেষ দিনগুলোতে যখন চলতে ফিরতে পারতেন না শক্তি স্যার বন্ধু প্রসুনের পথ চেয়ে বসে থাকতেন। যখন আর পারছেন না তখন ফোন করে বলতেন, “কেমন আছো? সুস্থ ত, কবে আসবে”। অমন উপুড় করা ভালোবাসায় হৃদয় ভরা থাকলেই হয়তো লিখা যায় –

 

আমরা প্রত্যেকটা মানুষ দুঃখী ভিতরে ভিতরে

কিন্তু কেউ কারো দুঃখকে ছুঁতে পারি না

আমরা প্রত্যেকটা মানুষ সুখী ভিতরে ভিতরে

কিন্তু কেউ কারো সুখকে ছুঁতে পারি না।

 

জীবনের শেষদিন গুলোতে বন্ধু প্রসূন সব থেকে বেশী সময় দিয়েছেন কবিকেজীবন সায়াহ্নে দুই বন্ধু কি গল্প করতেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে। অনুমান করতে পারি তাদের আড্ডার বিষয় যাই হোক না কেন তা এক কথায় প্রকাশ করলে হয়তো দাঁড়াবে – ভালবাসো, অন্তর থেকে বিদ্বেষ বিষ নাশো’’

১লা ফেব্রুয়ারি শক্তি স্যারের সতেরতম প্রয়াণ দিবস। এই দিনে কামনা এই যে আমরা যেন অন্তর থেকে বিদ্বেষ বিষ কে সমূলে উপড়ে ফেলতে পারি । বাগানে বৈচিত্র্য থাকুক। লাল গেরুয়া সবুজ যে রং আমাদের প্রিয় হোক না কেন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ভালোবাসাটা যেন অটুট থাকে। মানুষে মানুষে বন্ধন ও সম্প্রীতির আলো হাওয়ায় বরাক উপত্যকা সামনের দিকে এগিয়ে যাক। কবিকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

সিডনি | অস্ট্রেলিয়া |  ২৬.০১.২০২২

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২

হিন্দু স্টুয়ার্ট

 কলকাতা মহানগরী। ২০১১ -র এপ্রিল। ব্যাক্তিগত কাজে একাই আসা। হাতে ছিল কিছুটা অবসর সময়। তাই সচরাচর যা করা হয় না তাই করেছি। ফুটপাতে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেয়েছি। নৌকা করে বেলুড় থেকে গেছি দক্ষিণেশ্বর। রাস্তার ধারের সস্তা হোটেলে খেয়েছি মাছ-ভাত। বাসে ট্রামে করে কলকাতার পথে প্রান্তরে চষে বেরিয়েছি, গল্প-উপন্যাসে পড়া কলকাতা তিলোত্তমাকে খুব কাছে থেকে দেখবো বলে।

এরই এক ফাঁকে গিয়েছিলাম সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটরিতে। যেখানে রয়েছে ইংরেজ সাহেবদের কবর ও সমাধি সৌধ। সত্যজিৎ রায়ের লেখা, সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় গোরস্থানে সাবধান (২০১০) ছবিটির শূটিং হয়েছিল এখানেই। এই যায়গাটিতে শুয়ে আছেন তখনকার সময়ের অনেক বিখ্যাত মানুষ। ভাষাতত্ত্ববিদ ও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস, কবি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো, বিশ্ব বিখ্যাত ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের ছেলে ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্স, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা প্রদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি ইলাইজ়া ইম্পে, প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কলিন ম্যাকেঞ্জি সহ অনেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সম্ভবত এটিই ছিল ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম খ্রিস্টান সেমেটরি যা ১৭৬৭ থেকে ১৮৩০ অবধি সচল ছিল।
ভর-দুপুর বেলায় শ্যাওলা-ধরা কংক্রিট আর গা ছমছম করা নিস্তব্ধ পরিবেশে একা একা হাটতে হাটতে হঠাৎ এক সাহেবের সমাধি্র সামনে এসে দাঁড়াই। দেখতে পাই ভেতরে সমাধি-ফলকের ঠিক নিচে একটি পথ-কুকুর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। বুঝতে পারি যায়গাটা কত অবহেলিত। ফলক পড়ে জানতে পারি এটা জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্টের সমাধি, যিনি হিন্দু স্টুয়ার্ট নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এই সমাধিটি দেখতে বাকিগুলো থেকো একে বারেই আলাদা। অনেকটা হিন্দু মন্দিরের আদলে গড়া।
জানতে ইচ্ছে হলো কে এই হিন্দু স্টুয়ার্ট। আইরিশ এই সাহেবটি ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফার্স্ট বেঙ্গল ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার। ভারতে এসেছিলেন খুব অল্প বয়সে। আর এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৮২৮ সালের ৩১ মার্চ। মনে প্রাণে এই সাহেব ভারতীয় জীবন ধারা গ্রহণ করেছিলেন। এমন কি প্রেমেও পড়ে ছিলেন এক ভারতীয় নারীর। এই দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গ সাহেব গঙ্গাতে ধুতি-উত্তরীয় পরে নাকি নিয়মিত স্নান করতে যেতেন তাঁর কষ্টিপাথরের তৈরি, গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের বালগোপাল কে নিয়ে। ছিলেন কৃষ্ণ ভক্ত। বেদ-উপনিষদ্‌-পুরাণ-মহাকাব্য-সহ সব রকমের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধীয় শাস্ত্রপুঁথি ছিল তাঁর নখদর্পণে। তাঁর দেশীয় সাহেবসুবোরা তাঁকে ব্যঙ্গ করে ডাকতেন ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’ বলে। তিনি তাঁর স্বদেশীয় সাহেবদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভালোবেসে ফেলেছিলেন ধুতি-নেংটী পরা নেটিভদের।
এদেশের পোষাক-আষাক-রীতিনীতি সব কিছুকেই তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। ভারতীয় শাড়িতে মুগ্ধ স্টুয়ার্ট বলতেন শাড়ির মত ভাল আর কোন পোষাকই হয় না। ইউরোপের নারীদেরও শাড়ি পরার জন্য আহব্বান জানান। তাঁর মতে শাড়ি হলো 'elegant, simple, sensible, and sensual'।
কবরে শায়িত হিন্দু স্টুয়ার্ট কে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মন চলে গিয়েছিল সেই সময়কার কলকাতায়। ভাবছিলাম এই সাহেব কে নিয়েই হতে পারে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। হবে হয়তো এক দিন।

প র বা সে ন ব ব র্ষ

প্রবাসে দৈবের বশে এবার পনেরো বছর পূর্ণ হলো আমাদের। মনে পড়ে পনেরো বছর পূর্বে বাংলা নববর্ষের একদিন আগে দূরগামী উড়ুজাহাজে চড়ে পা-রেখেছিলাম ত্তশেনিয়ার এই দ্বীপ রাস্ট্র অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে। হঠাৎ করেই চাকরিটা পেয়ে চলে আসা। এটিই হলো আমাদের মানে আমি এবং আমার স্ত্রীর প্রথম বিদেশ যাত্রা। কখনো ভাবিনি এই শহরটাই একদিন হয়ে উঠবে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা। বরাক উপত্যকার আলো-হাওয়া-রোদ্দুরে বেড়ে ওঠা এই সদ্য বিবাহিত বাঙালি দম্পতির কাছে তখন এদেশের সব কিছুই ছিল নতুন। যানজটহীন-ঝকঝকে-তকতকে-রাস্তাঘাট দেখে আমাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। কালক্রমে সেই প্রথম দেখার বিস্ময় আজ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

যদিও নতুন কোন দেশে মানিয়ে নিতে একটু বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হয়, আমাদের ক্ষেত্রে ব্যপারটা অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমরা হোটেলে না উঠে, উঠেছিলাম এক বন্ধুর বাড়িতে। যেদিন সিডনি পৌঁছলাম তার পরদিনই বন্ধুটি নিয়ে গেলো টেম্পি পার্কের বৈশাখী মেলায়। আয়োজক প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটি। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ লেকের জলের ধারে পার্কের বিশাল সবুজ মাঠে মেলা বসেছে। অস্থায়ী তাঁবুতে নানান রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রবাসী বাঙালিরা। সুদুর অস্ট্রেলিয়ায় এসে একসঙ্গে উৎসবমুখর এত বাঙালি দেখে আমরা যার পর নাই আনন্দিত হয়েছিলাম সেদিন। সেটাই দেশের বাইরে আমাদের প্রথম নববর্ষ উদ্‌যাপন।
আমরা বাঙালিরা যেখানেই যাই সেখানেই দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যাই। সেই ধারা বজায় রেখে, সিডনিতেও বৈশাখী মেলা হয় দু’টি। একটি টেম্পি পার্কে(স্থান পরিবর্তিত হয়ে এখন ফেয়ারফিল্ড সো গ্রাউন্ডে) আর অন্যটি অলিম্পিক পার্কে। এই অলিম্পিক পার্কের মেলাটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঙালি মেলা। প্রতি বছরই মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকি। এই উপলক্ষ্যে শুধু সিডনি-ক্যানবেরাই নয়, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি বহির্দেশ থেকেও বাঙালিরা আসেন সিডনিতে। প্রবাসে দুই বাঙলার মানুষ মিলে মিশে আনন্দে মেতে উঠেন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকে আসেন নামি দামি শিল্পীরা। লোকে টিকেট কেটে মেলা দেখে। বিভিন্ন পণ্যের স্টল বসে। নানা রকমের সুস্বাদু খাবার, বই, পোশাক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকে মেলা প্রাঙ্গণে।
কে না জানে যে বাঙালি বরাবরই এক স্মৃতিবিলাসী জাতি। এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসেও নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের স্মৃতি আমাদের কাছে ফিরে ফিরে আসে। পয়লা বৈশাখে নতুন কাপড় পরা, ভালো খাওয়া-দাওয়া কিংবা দোকানে দোকানে ঘুরে শুভ হালখাতার মিষ্টি মুখ করা - কিছুই ভুলি না। প্রবাসে এসেও স্বচ্ছল বাঙালির স্মৃতিবিলাসের কোন কমতি নেই। ইন্টারনেটে একটু সার্চ দিলেই দেখা যাবে নিউইয়র্ক, লন্ডন থেকে শুরু করে সূদুর টোকিওর নববর্ষ উদ্‌যাপনের ছবি। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণের উৎসব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা - এখন কার্নিভ্যাল রূপ ধারণ করেছে। ইন্টারনেট আর ফেইসবুকের বদৌলতে সে খবর সবারই এখন জানা।
বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অংশ পয়লা বৈশাখের মেলা ও উদ্‌যাপনের ছবিটা অনেক খানিই পাল্টেছে আজ। এক সময় যে জাতি ছিল কৃষিনির্ভর সে আজ বসতি গড়েছে নগরে। ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে। আগেকার দিনে মেলায় পাওয়া যেত মাটির বাসন, কাঠের তৈজসপত্র, তালপাতার বাঁশি। সেই চিত্র আজ আর চোখে পড়ে না। সময়ের সাথে মেলার চরিত্রও পাল্টেছে। কিন্তু মাত্র কয়েক প্রজন্ম পেছনে গেলেই আমরা আমাদের কৃষিনির্ভর পূর্বপুরুষের শরীরে পলিমাটির গন্ধ খুঁজে পাবো। সেটাই আমাদের কিংবদন্তি। আমাদের শরীর-মন আজও গোপনে বহন করে চলেছে আমাদের পূর্বপুরুষের সেই পরম্পরা। এটা বুঝতে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হয় না। এই দূরদেশের বৈশাখী মেলায় এসেও দেখতে পাই প্রবাসী বাঙালিরা পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ ভাজায় রসনা বিলাস করছে পরম তৃপ্তিতে। এ যেন সেই অতীতের গ্রাম্যজীবনে ফিরে যাওয়ার আকূল চেষ্টা।
বাঙলা নববর্ষ মোঘল সম্রাটদের হাত ধরে এসেছিল কৃষিবর্ষ বা খাজনাবর্ষ হিসেবে। হালখাতা, পুণ্যাহ অনুষ্ঠান সেই দিনগুলোরই ইঙ্গিত করে। কিন্তু কালক্রমে বাঙালি এই দিনটিকে সর্বজনীন উৎসবের দিনে পরিণত করেছে। যে দিনটি ছিল শোষনের প্রতীক, খাজনা আদায়ের দিন, সেই দিনকেই বাঙালি করে তুলেছে আনন্দের দিন। চৈত্র মাসের খরতাপ-অনাবৃষ্টির পরে এ যেন বৈশাখের বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি। সেই গ্রামীণ লোকায়ত জীবন থেকে বাংলা বর্ষবরণ আজ উঠে এসেছে শহুরে জটিল জীবনের আবহে। এই প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনে বাঙলা ক্যালেণ্ডারের কোন যায়গা নেই। এখানে পয়লা বৈশাখ আসে এপ্রিল মাসে। এপ্রিল ফুলের দিন থেকেই অনলাইনে শাড়ি, পাঞ্জাবীর কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। প্রবাসে পরবাসে থেকেও এই একটি দিন বঙ্গ-সন্তানেরা শাড়ি পাঞ্জাবী পড়ে বৈশাখী মেলায় যায়। মাটির পাত্রে পান্তা-ইলিশ খায়। পিকনিক পিকনিক অনুভূতি হয়। এই দেখে মনে পড়ে যায় ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’।

পু ন র্মি ল ন 🍂

  দেখা হলো মুঠোফোনে! 'জীবন গিয়েছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার'! না তার থেকেও বেশী হবে? ফিরে ফিরে আসে কাঠালতলা-কুসুম ভোর, মনপড়ে বয়েস হোষ্ট...