রবিবার, ১৯ মে, ২০১৩

মাতৃভাষার মৃত্যু ও অন্যান্য

       পাঠক, ভাবুন আপনার মাতৃভাষা এমন একটি ভাষা যা একমাত্র আপনিই জানেন। এই বিশাল বিশ্বে আর কেউ নেই যিনি আপনার ভাষা বলতে বা বুঝতে পারেন। আপনার মৃত্যুর সাথে সাথে হাজার বছরের পুরোন পিতৃপুরুষের ভাষার ও মৃত্যু ঘটবে। এই ভাবনাটা ভয়ঙ্কর। এই সেদিন আন্দামানের আকা বো ( Aka Bo ) নামক একটি ভাষার শেষ কথোপকথনকারী মারা গেলেন। কী ভীষণ রকমের কষ্ট বুকে নিয়ে উনি এই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন তা ভাববার মতো মানসিক শক্তি আমার এই মুহূর্তে নেই। জীবিত থাকা অবস্থায় এই ভিডিওটি ধারণ করা হয়। দেখুনঃ

        আপনি যখন এই লেখাটি পড়তে পারছেন তখন ধরে নিচ্ছি আপনি একজন বাঙালী । আপনি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যাদের ভাষাটি এই মূহুর্তে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। আপনি এই লেখাটি পড়ার সময় প্রতি চৌদ্দ দিনে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের অতলে। সে সব মৃত ভাষা গুলোর স্থান হচ্ছে ধুলি ধূসর কোন এক সংগ্রহশালা। ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ভাষা পণ্ডিত আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, একুশ শতকের মধ্যেই পৃথিবী থেকে ৯০ শতাংশ ভাষা চিরতরে বিলুপ্ত হবে। ইউনেস্কোর মতে পৃথিবীতে প্রায় ৬০০০ ভাষা হারিয়ে যাওয়ার বিপদে রয়েছে। এই মূহুর্তে আপনার ভাষাটি যদিও হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই তার মানে এই নয় যে তা হারিয়ে যেতে পারে না। পরাক্রমশালী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষা মেসোডোনিয়ায় কথা বলেন এখন খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। পৃথিবীর প্রধানতম ধর্ম প্রণেতা যীশু যে-ভাষায় কথা বলতেন সেই ভূমধ্যসাগরীয় আরামাইক ভাষা ও প্রায় বিলুপ্তির পথে । এরকম অনেক উল্লেখযোগ্য ভাষাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।



ভাষা কি ও পৃথিবীতে কতটি ভাষা আছে?



        ভাষা একটি সচল ও ক্রম পরিবর্তনশীল সত্তা যা দিয়ে মানুষ শব্দ, চিহ্ন কিংবা শারিরিক অভিব্যক্তির সাহায্যে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে । ভাষার এই সচলতা ও ক্রম পরিবর্তনশীল চরিত্রের জন্য এর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ কঠিন কাজ। অনুমান করা হয় যে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০০ শতকে পৃথিবীতে প্রায় ২০০০০ সচল ভাষা ছিল। ভাষা পণ্ডিতদের মতে সেই সংখ্যা কমে বর্তমানে সচল ভাষা রয়েছে মাত্র ৬৫০০ । এই ভাষা গুলোর রয়েছে এক বা একাধিক মাতৃ ভাষাভাষী বক্তা (native speaker) । তাদের প্রথম ভাষা (first language ) হিসেবে এটি জন্মসূত্রে প্রাপ্ত।

কেন ভাষা হারিয়ে যায়?


       বিভিন্ন কারণে ভাষা হারিয়ে যেতে পারে। একটি অন্যতম কারণ নগরায়ণ ( urbanisation ) । আজকের এই গ্লোবালাইজড বিশ্বে অর্থনৈতিক কারণে প্রব্রজনের ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায় এক সাথে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। একটি কুকি ভাষাভাষী পরিবার এবং একটি চাকমা পরিবার যদি গৌহাটিতে অভিবাসী হয় তবে তারা হয়ত একে অন্যের সাথে সেখান কার কাজের ভাষা অসমিয়া বা হিন্দি তে কথা বলবে। সেই কুকি-চাকমা পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়তো মা-বাবার কাছ থেকে একটু আধটু মাতৃভাষা শিখবে, কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মে এসে সেই প্রাসঙ্গিকতাও হারাবে। মানুষ কেন নগরমুখী হয় তা নিয়ে অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। এই নগরায়ণ খুব দ্রুত পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের ভাষিক ল্যান্ডস্কেপ। নগরায়ণ থেকেও বিপদজনক কারণটি হল রাষ্ট্র নিজে। 

        ছোট ছোট জাতি সত্তা গুলো বার বার রাষ্ট্রের কাছে হারিয়েছে তার ভাষা ও সংস্কৃতি। এই সত্তা গুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়া হয় রাষ্ট্রের সাথে একাত্ম ( assimilate ) করতে । অস্ট্রেলিয়ার Stolen Generation এর কথা আমরা সবাই জানি। কিভাবে মায়ের কোল থেকে জোরপূর্বক আদিবাসী ( aboriginal) ছেলে মেয়েদের নিয়ে গিয়ে বদলে দেয়া হতো তাদের ভাষা সংস্কৃতি তা আজো অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়। ঠিক তেমনি ১৯৬১ সালে ভারতের আসাম সরকার, আসামের সংস্কৃতি ও ভাষিক বৈচিত্র্য কে নষ্ট করে দিতে প্রচেষ্টা চালিযে ছিল। যার প্রতিবাদে ১৯ মে এগারো জন শহিদ হয়েছিলেন আসামের শিলচরে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যুগেযুগে বিভিন্ন ভাবে ভাষিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে সচেতন ভাবে। উপনিবেশিক শক্তির যাঁতাকলে পরে ও হারিয়ে গেছে অনেক ভাষা-সংস্কৃতি । আমাদের এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী ক্রমেই একমাত্রিক হয়ে ওঠার চেষ্টায় ব্রতী। সংস্কৃতি ও ভাষিক বৈচিত্র্য ( cultural and linguistic diversity ) হারিয়ে দেশে দেশে তৈরী করা হচ্ছে হ্যারি পটার প্রজন্ম। এ প্রজন্ম না পারছে চিনে নিতে নিজের সংস্কৃতি, না পারছে অন্য সংস্কৃতি কে শ্রদ্ধা করতে। ভুলতে বসেছে যে নিজে কে জানার মাঝেই লুকিয়ে আছে অন্যকে জানার ও সম্মান করার চাবিকাঠি।

       এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ইন্টারনেটে ইংরেজী ভাষার আধিপত্য অন্যান্য ভাষার প্রচার ও প্রসারকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কিছু কিছু ভাষার মিডিয়া মনোপলি অপেক্ষাকৃত ছোট ভাষাগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে বিপরীত ভূমিকা পালন করছে। শিশুরা ভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র, কার্টুন যাই দেখুক না কেন, সে ভাষা ক্রমে তার মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে । তারা ক্রমে শিখে ফেলে সে ভাষা এবং এক সময় সে ভাষা ব্যবহারও করে। আর এভাবে ব্যবহার করতে করতে এক সময় ভুলে যায় পিতৃপুরুষের ভাষা। দূর্বল হয়ে পড়ে পারিবারিক যোগসূত্র (লিঙ্ক) । তৃতীয় প্রজন্ম ( নাতি) বুঝতে পারে না প্রথম প্রজন্মের ( দাদু ) ভাষা। যদিও বা যোগসূত্রটুকু থাকে তাও হয়ে পড়ে ভীষণ রকম নড়বড়ে।


ভাষা হারিয়ে গেলে কি হয়?


       সংস্কৃতি ( culture ) বলতে আমরা বুঝি আমাদের সামগ্রিক জীবন যাপন প্রক্রিয়া যা হাজার হাজার বছরের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় পিতৃপুরুষের হাত ধরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে । বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এই জীবনযাপন প্রক্রিয়া আলাদা। আর সেই আলাদা বিশ্বাস,মূল্যবোধ ও জীবনযাপন প্রক্রিয়া দিয়েই চেনা যায় তাদের আলাদা করে । মূলত সেটাই তাদের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় ( ethnic identity )। সেই পরিচয়ের মৌলিক একটা উপাদান হলো ভাষা। সংস্কৃতি প্রকাশের আধার এটি। আমাদের বিশ্বাস,মূল্যবোধ ও জীবন যাপন প্রক্রিয়া এর দ্বারা প্রবাহিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। আমাদের সামগ্রিক পরিচয় ও সংহতির ধারক ও বাহক ভাষা। আমরা যেহেতু সেই সমগ্রের অংশ তাই ভাষা আমাদের আত্ম পরিচয়ের অংশও বটে। ভাষার মৃত্যু মানে সেই সংস্কৃতি ও পরিচয়ের মৃত্যু।

আসুন নিজ নিজ মাতৃভাষা কে তার উপযুক্ত সম্মান দেই। নিজের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের মৃত্যুকে প্রতিরোধ করি।

সোমবার, ১৩ মে, ২০১৩

কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী ( ১৯৩৭ - ২০০৫ )

সপ্তডিঙা মধুকর চারিদিকে জল
শ্রাবণের অবিশ্রাম মনসা-মঙ্গল
পচা পাটে এঁদো ডোবা বিষধর ফণা
ছেঁড়া কাঁথা-কাণি আর বাহুলা-যন্ত্রণা
হু হু করা কালসন্ধ্যা ভেসে আসা গানে
সায়ের ঝিয়ারি যায় অনন্ত ভাসানে ।
কোথায় নিছনি কোথা চম্পক-নগর
সাতনরী শিকা ঝোলে ঘরের ভিতর
কুপিলম্পে রাতকানা নিরক্ষরা বুড়ি
লখা’র মরণে কান্দে আছুড়ি-পিছুড়ি
জাল-টানা ছেলে আজ রাতে গেছে জলে
রেখো মা মনসা তার সর্বাঙ্গ কুশলে ।
গাঙের গর্ভিণী সেই গন্ধ ভেসে আসে
শ্রাবণীর দিগম্বরা দখিনা বাতাসে
এখনো বুকের দ্বিজ বংশীদাস কহে
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কালীদহে…
ডহরের ঘোর-লাগা গহনের টানে
সায়ের ঝিয়ারি যায় অনন্ত ভাসানে ।

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়

কারা যেন বাড়ি করছে গগন চুম্বী আশায় আমি তখন ব্যস্ত থাকি আরেক ভালবাসায়।   কলেজ রোড পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলে রাস্তাটা দু দিকে চলে গেছে। এক ...